প্রকাশনা শিল্পে নারীর মনস্তাত্বিক যুদ্ধ
প্রকাশিত: ১৬:১৫ ৬ জুলাই ২০২২ আপডেট: ১৮:২৩ ৬ জুলাই ২০২২

ছবি: সংগৃহীত
প্রকাশনা পেশায় নারীর জন্য বড়, বিস্তৃত ও জালের মতো চ্যালেঞ্জ থাকে। যাকে বলা যায়, সামাজিক চ্যালেঞ্জ, সামাজিক সমস্যা। এই পেশায় নারীর অংশগ্রহণ এখনও সন্তোষজনক নয় বলে মনে করছেন খোদ প্রকাশনা শিল্পে জড়িত অনেকেই। তাই বলে, নতুন কেউ এই পেশায় আসছে না বিষয়টি তাও নয়। পরিবার যখন বাধা হয়ে দাঁড়ায়- অনেকেই বাধ্য হয় স্বপ্ন আর ভালোবাসা দিয়ে সাজানো সংসার থেকে বের হয়ে আসতে। তার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কোনো বইয়ের মলাটে লেগে থাকে না ঠিকই বরং তা আরো জীবন্ত শিল্প হয়ে ওঠে। মমতা-ভালোবাসার সঙ্গে দক্ষতার সমন্বয় ঘটিয়ে এই পেশায় এগিয়ে যাওয়াকে তারা ‘গৌরবের’ মনে করেন। এসব প্রকাশকরা অবদান রাখতে চান সংস্কৃতি ও মননশীল উন্নয়নে। কতজন আছেন এই পেশায়- কেমন আছেন তারা?
নাহিদা আশরাফী, কর্ণধার- ‘জলধি’ প্রকাশনা সংস্থা
নারী হওয়ার কারণে আলাদা পরিস্থিতিতে পড়তে হয় কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, ‘একজন লেখকের বই প্রকাশ করার আগে সমস্ত প্রক্রিয়া মেনে কাজ সম্পন্ন করার পরও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখকের সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে এর সংখ্যা খুবই কম। জলধি তার কাজের ব্যাপারে যথেষ্ট মনোযোগী। বই তাদের কাছে শুধু একটি প্রোডাক্ট নয়, শিল্পও বটে। তাই আলাদা পরিস্থিতিকে শক্ত হাতে সামলানোর যথেষ্ট যোগ্যতা প্রকাশক হিসেবে রাখি। কারণ, নিজেকে কখনোই নারী প্রকাশক নয়, একজন প্রকাশক হিসেবেই দেখেছি। তবু কিছু প্রতিবন্ধকতা থেকেই যায়। যা উত্তরণের পথ আমাদেরই খুঁজে নিতে হয়।'
জান্নাতুন নিসা, কর্ণধার, য়ারোয়া বুক কর্নার
২০১৭ সালে আমি আমার প্রকাশনা শুরু করি। এর পরের বছর ‘বাংলাদেশ নারী প্রকাশক সমিতি’ গঠন করি, সেখানে ৫৫জন নারী প্রকাশক সদস্য অন্তর্ভুক্ত হয়। এখন আরো বেড়েছে। তখন আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিয়েছিলাম। সেই কমিটির কার্যক্রম এখনও চলছে।
এই পেশায় আসার কারণ সৃজনশীল কাজের প্রতি ভালোবাসা। একই সঙ্গে অনুবাদ সাহিত্য সম্প্রসারণের মাধ্যমে একদেশের সাহিত্য অন্য দেশের ভাষাভাষীর মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
তিনি বলেন, ‘আজকে আমরা যেসব বিখ্যাত অনুবাদ সাহিত্য পড়ছি- এর কারণ হচ্ছে কোনো না কোনোভাবে তা মুদ্রিত হয়েছিল।’
ইংরেজি সাহিত্যে কীভাবে অনুরাগ তৈরি হলো? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, শিক্ষাজীবনে সাহিত্যের প্রতি বিশেষ করে অনুবাদ সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ তৈরি হয়। তিনি যখন প্রকাশনা পেশায় আসতে চেয়েছেন, পরিবার থেকে বাধা ছিল, এক সময় বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন এই পেশাটিও গর্বের। এখানে ব্যবসাটা হয়তো ঠিকমতো প্রতিষ্ঠা পায়নি, তবে যে ভিত্তি তৈরি হচ্ছে- সেখান থেকেই পরবর্তী প্রজন্মের নারীরা ভালো অবস্থানে চলে যাবে।
আলেয়া বেগম, প্রকাশক, পাতা প্রকাশনী
প্রকাশনা শিল্পের সংকট নিয়ে প্রশ্ন করলে পাতা প্রকাশনীর কর্ণধার আলেয়া বেগম বলেন, ‘এই শিল্পে সংকট বলে শেষ করা যাবে না। বিশেষ করে করোনাকালে বিশাল ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরণের প্রণোদনা দেওয়া হয়নি। এবছর অনেক প্রকাশক স্টল নেননি। আবার অনেকে এই ব্যবসা একেবারে ছেড়ে দিয়েছেন। সংস্কৃতির উন্নয়নে প্রকাশনা শিল্পের প্রতি সরকারের আরেকটু সুদৃষ্টি থাকা উচিত।’
তিনি আরো বলেন, ‘হাজারো লেখক তৈরি হচ্ছে, তাদের মধ্যে অল্প কিছু লেখকের লেখা বই ভালো বিক্রি হয়। বই মেলা চলাকালে বেশ ভালো আয় হয়, তবে এই সময়ের আয় দিয়ে সারা বছর চলা যায় না। এটা এখন আশাও করি না। আমার বাবার বাড়ির পরিবারের কাছ থেকে সব সময় সহযোগিতা পেয়েছি কিন্তু দাম্পত্য জীবনে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি। বারবার বলা হয়েছে- সন্তান রেখে এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না। আমি কিছুতেই বোঝাতে পারিনি আমার সন্তানও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, আমার পেশাটাও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।’
আলেয়া বেগম বলেন, ‘চারপাশের যে পরিবেশ, কাজের প্রয়োজনে রাত ৩ টায় যখন প্রেস থেকে বাসায় ফিরি- যে জানে আমি প্রেস থেকে বাসায় ফিরলাম সে তো জানেই, আর যে জানে না সে চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে। যারা জানে না তাদের সংখ্যা দশ জনের মধ্যে নয়জন। বিষয়টা বোঝা গেল?’
যেসব নতুন নারী প্রকাশনা শিল্পকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করছেন তাদের পক্ষে এই ধকল কাটিয়ে ওঠা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের সমান।
ডেইলি বাংলাদেশ/কেবি