সমসাময়িক বিষয়, তৃতীয় মাত্রা চ্যানেল আই ০১০৫ ঘটিকা ২৭ নভেম্বর ২০২০
2020-11-27 01:05:00
ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনঃ
আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাচ্ছিলাম। আমাদের রিক্সাটা যখন ঠিক টিএসসি রোডের মুখে আসলো তখন আমি মিলনকে বললাম যে তুমি আমার রিক্সায় আসো। ও আমার রিক্সায় আসলো, আমরা একসাথে রওনা দিলাম। হঠাৎ করে দেখলাম যে মিলন ঢলে পড়ল আমার কোলে, শুধু বলল যে জালাল ভাই দেখেন কি হয়েছে। মিলন আর কিছু বলতে পারেন নাই। আমি দেখছিলাম বাংলা একাডেমির দিক থেকে তখন একটা মিছিল আসছিল। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উত্তপ্ত ছিল। রাজনৈতিক ১৫ দল, ৭ দলও তখন আন্দোলনরত ছিল। তখনকার প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে বিরাজমান ছিল আন্দোলন-সংগ্রাম, মিলন এটাকে আরো ত্বরান্বিত করেছিল। এর কয়েকদিন পরে এরশাদের পতন ঘটল।
আমান উল্লাহ্ আমানঃ
ডা. মিলন যখন গুলিবিদ্ধ হয় তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল ছিল এবং আন্দোলন সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি অলিগলিতে বিশেষ করে টিএসসি চত্বরে, সেখানে স্বৈরাচার বাহিনীরা বিভিন্ন জায়গা থেকে গুলি চালিয়েছিল। পেশাজীবীরা আন্দোলনটা শুরু করলেন তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে এবং স্বৈরাচারীদের পতনের জন্য, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে। আজকের ছাত্রমৈত্রী তৎকালীন সভাপতি জহির উদ্দিন স্বপন সেখানে আহত হন। সেই মিছিলে আমরা অনেকেই আহত হই এবং পরবর্তীতে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে সেখান থেকে হরতালের আহ্বান করি। সেই হরতালের মধ্যে দিয়ে আন্দোলন আরো বেগবান হয়। জাতীয় নেতৃবৃন্দরা আন্তরিকভাবে সেখানে তাদের কর্মসূচি ঘোষণা করলেন। আমাদের আন্দোলন আরও বেগবান হলো এবং স্বৈরাচার মুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সকল পর্যায়ের ব্যক্তিরা সেদিন রাজপথে নেমে ছিল।
অসীম কুমার উকিলঃ
আমরা এক সুরে সবাই বলেছিলাম যে স্বৈরাচারের পতন না ঘটিয়ে আমরা ঘরে যাবো না। বিএনপি তখন ছাত্রদল নির্ভর হয়ে আন্দোলনটা করেছিল। কারণ বিএনপির বাঘা বাঘা নেতারা একে একে সবাই এরশাদের সহযোগী হয়ে গেছিল। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আহ্বায়ক খোকন নির্ভর হয়ে সারা দেশে আন্দোলনটার সহযোগী হয়েছিলেন। আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও ফুল সাপোর্ট ছিল, নিঃস্বার্থ সমর্থক ছিলেন তিনি। আমরা সফলতার সাথে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলাম।
ডা. মুশতাক হোসেনঃ
এরশাদ সরকার তার স্বৈরশাসনকে নাড়া চাড়া দিয়ে উঠতে চেয়েছিল, তার প্রতিবাদে সে সময়ে সাবেক পিজি হাসপাতালে একটা প্রতিবাদ সভা হয়েছিল। সেই প্রতিবাদ সভায় যোগদান করার জন্য ডা. মিলন হাসপাতালে এসেছিল, আমিও হাসপাতালে ছিলাম। আমাদেরকে দেখাশুনা করে ডা. মিলন রিক্সায় উঠে যাচ্ছিল। জালাল ভাইও তার বাসা থেকে যাচ্ছিলেন। তবে কি মনে করে তিনি মেডিকেল চত্বরের মধ্য দিয়ে আসছিলেন। সেই সময় ডা. মিলনের সাথে জালাল ভাইয়ের দেখা হয়। রিকশা থামিয়ে উঠতে না উঠতেই মিলন গুলিবিদ্ধ হয় এবং জালাল ভাইয়ের কোলে মিলন ঢলে পড়ে। মিলন কোনো রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। তার মৃত্যুটা গোটা শহরে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি একজন চিকিৎসক, বিএমএর নেতা। যিনি রোগীদের চিকিৎসার জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দেন এরকম একজন ডাক্তারকে এরশাদ হত্যা করেছে। এই কারণে স্রোতের মতো মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল।
খায়রুল কবির খোকনঃ
আপনারা জানেন জিহাদের লাশটি নিয়ে যখন আমরা এদেশের সকল গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল ছাত্র সমাজ, সংগঠন এবং সর্বদলীয় ছাত্র দল গঠন করেছিলাম। গঠন করার পরবর্তীতে আমাদের আন্দোলন চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারই অংশ হিসেবে আমাদের ধারাবাহিক কর্মসূচি চলছিল। সেই কর্মসূচির মধ্যেই দিয়ে ২৬ তারিখ জিরো পয়েন্টে আমাদের প্রতিবাদ সমাবেশ ছিল। সমাবেশ থেকে আমরা শুনলাম পথে একজন শিশু বা কর্মী মৃত্যুবরণ করেছে, আমরা সেই সমাবেশ থেকে সেখানে ছুটে এসেছিলাম। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে সে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল এবং একটা মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল।
এস এম কামাল হোসেনঃ
২৭ শে নভেম্বর বিএম এর মহাসচিব মিলন ভাই ঘাতকের বুলেটে শাহাদাত বরণ করেন। সেসময়ে সামরিক শাসকেরা আমাদের অনেককেই কেনার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ছাত্রদলের একটা বড় অংশ যারা ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ করতো তাদেরকে তারা কিনতে সক্ষম হয়েছিল। সেসময় ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল যে, কোন মিছিল হবে না। বিশেষ করে খায়রুল কবির খোকন ও আমান উল্লাহ আমানকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে দিবেনা। আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে এসে সমাবেশ করলাম। সেদিনের সমাবেশের মধ্যেই নির্ভর করেছিল অপরাজেয় বাংলার। স্বৈরাচারী এরশাদ মনে করেছিল একজনকে হত্যা করতে পারলেই হয়তো আন্দোলন থমকে দাঁড়াবে
জহির উদ্দিন স্বপনঃ
জিহাদ যেদিন মৃত্যুবরণ করে ঠিক সেদিনই আমাকে সরকারি নির্যাতনে দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। এরপর থেকে সশরীরে উপস্থিত থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। দীর্ঘসময় এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, এই যে এত রক্ত, এরপরও ঘটনাটা ৩টা পর্যায়ে গুণগত পরিবর্তন লাভ করেছিল। সেদিন এরশাদের যে অবৈধ শাসন ছিল, বিনা ভোটের একটা শাসন ছিল, তার বিপরীতে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় ছিল কিন্তু আমাদের প্রধান দাবি। এবং সকলদলের মধ্যে গ্রহণযোগ্যভাবে একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য কেয়ারটেকার ব্যবস্থার একটা দাবি উঠেছিল। শহীদ ডা. মিলনের আত্মত্যাগ যদি আমরা স্মরণ করতে চাই তাহলে বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থে ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে হবে।
সেলিনা আকতারঃ
মিলন ছাত্রজীবন থেকে একটা রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিল। মিলন বিশ্বাস করতো যে রাজনৈতিক শিক্ষাগ্রহণ ছাড়া রাজনীতি বোঝা সম্ভব না। দেশকে ভালো না বাসলে, দেশের অর্থনীতি না বুঝে এবং দেশে বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে না পারলে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়না। দেশের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব চিকিৎসকদের। মিলন বিশ্বাস করতো শুধু রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার মধ্যেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। রোগীর সাথে সুসম্পর্ক রোগীকে সেবাদানের একটি পূর্বশর্ত। মিলন ছিল বিএমএর মহাসচিব। সেজন্য ওর দায়িত্ব ছিল অনেক। তাকে চাকরি জীবনে নানা রকমভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তাকে ট্রান্সফার করা হয়েছিল ভারতীয় বর্ডারের কাছাকাছি। যেখানে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কোন অবকাঠামো-ই ছিলনা। তাকে অফার দেয়া হয়েছিল যদি সে আন্দোলন ছেড়ে দেয় তাহলে তাকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হবে, কিন্তু সে তাতে রাজি হলো না। মিলনকে চাকরীচ্যুত করা হয়। মিলন যে সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিল, গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছিল তার স্বপ্ন সার্থক হয়নি।