যে হাতে ছিল পত্রিকা, শতবর্ষী হকার সৈয়দের সেই হাতে ভিক্ষার থালা
প্রকাশিত: ১৩:৪৫ ১৭ জানুয়ারি ২০২২ আপডেট: ১৮:১৪ ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২
সৈয়দ আহম্মদ ভূঁইয়া! তার জন্ম পহেলা মার্চ ১৯১১। মৃত মকরম আলী ও মৃত আম্বিয়া ভানুর ছেলে হকার সৈয়দ আহম্মদ ভূঁইয়ার বয়স এখন প্রায় ১১১ বছর। কাগজ কলমে অশিক্ষিত হলেও তার হৃদয় ছিল আলোকিত।
বাংলাদেশে সবচেয়ে আদি পত্রিকা বিক্রেতা ছিলেন সৈয়দ আহম্মদ ভূঁইয়া। পত্রিকা বিক্রি কালেই তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০-এর গণ-আন্দোলনসহ সব ঐতিহাসিক আন্দোলন দেখেছেন। এ সকল ঘটনার স্বাক্ষী তিনি নিজেই। ধারণা করা হচ্ছে তার সমবয়সী মানুষ এখন কেউ নেই।
কর্মজীবনের শুরুতে প্রথমে নৌকায় কাজ করতেন। এর পর স্থানীয় এক মাওলানার সহযোগিতায় প্রায় ৮৫ বছর আগে পত্রিকা বিক্রির কাজ শুরু করেন তিনি। সাল-তারিখটা ঠিক মনে করতে পারছিলেন না। তবে ইংরেজ আমলে ভারতীয় পয়গাম পত্রিকা বিক্রি করেছেন। পরে আজাদ, ইত্তেফাক, যুগশঙ্খ আর সংবাদ পত্রিকা বিক্রি করতেন। দুই পয়সা, চার পয়সায় পত্রিকা বিক্রি শুরু করেছিলেন তিনি।
এভাবে নিজের অজান্তেই পত্রিকার সঙ্গে নিজের জীবনকে পুরো জড়িয়ে নেন সৈয়দ আহমদ। তার পর টানা প্রায় ৮০ বছর পত্রিকা বিক্রির সঙ্গেই ছিলেন। তার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে চরম দুঃখ কষ্টে। তবুও এক সময় হৃদয়বান এ মানুষটি শিশুদের পাঠশালার জন্য দান করেছেন পৌরসভার চার শতক জমি। আর মুসল্লিদের জন্য দিয়েছেন মসজিদের জায়গা।
লক্ষ্মীপুর পৌরসভার বাঞ্চানগর এলাকায় ৫ বছর ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তার ৬ ছেলে ও মেয়েরাও ষাটোর্ধ্ব বয়সী। তবে এখন ভিক্ষাবৃত্তিই তার পেশা। যেখানে পত্রিকা নিয়ে সকালে বের হতেন পাঠকদের চাহিদা মিটাতে, এখনো সেভাবেই বের হন। তবে ভিক্ষার থালা হাতে নিয়ে। নিজের চাহিদা মিটাতে বিক্ষাবৃত্তি করে ঘুরেন এদিক থেকে ওদিকে। এ বয়সে ভিক্ষার ঝুলি বহন করতে আর পারছেন না তিনি।
লাঠিতে ভর করে লক্ষ্মীপুর শহরে ঘুরে বেড়ান জীবিকার সন্ধানে। চোখে ঠিকমতো না দেখলেও তিন বেলা আহারের খোঁজে প্রতিদিনই বের হয় পথে ঘাটে। পুরোনো পত্রিকার গ্রাহকরা তাকে দেখলেই জড়িয়ে ধরে সান্তনা দেন।
তার এক ছেলে আবুল কালাম (৬০) বাবার পেশা পত্রিকা বিক্রি ধরে রেখেছেন। কিন্ত বর্তমান দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে পত্রিকা বিক্রির পয়সায় তারও সংসার চলে না। অন্য ছেলেদের কোনোভাবে সংসার চললেও ষাট বছর বয়সী স্বামী পরিত্যক্ত দুই মেয়ে আর শতবর্ষী স্ত্রীসহ চারজনের মুখে দু-মুঠো খাবার তুলে দিতে পথে নামতে হয় তাকে। কিন্তু বয়সের ভারে কোনো কঠিন পেশা তিনি করতে পারেন না। সেজন্য ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে এখন জীবন চালাচ্ছেন তিনি।
জানা যায়, ১১১ বছর বয়সী সৈয়দ আহম্মেদ এক সময় লক্ষ্মীপুরের পথে ঘাটে পত্রিকা নিয়ে হাজির হতেন মানুষের ধারে। স্থানীয়ভাবে সৈয়দ হকার নামে এ ব্যক্তিটি জীবনের আশিটি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন পত্রিকা বিক্রি করে।
হকার সৈয়দ আহম্মদ ভূঁইয়া বলেন, সে সময়ে লক্ষ্মীপুরে সরাসরি পত্রিকা আসতো না। নোয়াখালীর চৌমুহনীতে রেলগাড়িতে পত্রিকা আসতো। সেখান থেকে বাসে করে লক্ষ্মীপুরে পত্রিকা নিয়ে আসতাম। তারপর তা পাঠকের হাতে পৌঁছে যেত প্রকাশের তিন-চার দিন পরে। প্রতিদিন পত্রিকা পৌঁছে দেয়াও সম্ভব হতো না।
তিনি আরো জানান, কিছু সময় ডাক হকররা পায়ে হেঁটে পত্রিকা পৌঁছে দিতেন। তখনও সকালবেলার পত্রিকা আসতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। সন্ধ্যার সময় পত্রিকা বিক্রির জন্য বের হতেন তিনি। শারীরিক অসুস্থতার কারণে গত কয়েক বছর থেকে আর পত্রিকা বিক্রি করতে পারছেন না। কালের বিবর্তনে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়ে পত্রিকা ছেড়ে ভিক্ষার ঝুলি হাতে নেন।
তিনি জানান, অনেক সংবাদকর্মী, অনেক সম্পাদক হারিয়েছেন তিনি। বিশেষ করে স্থানীয় সাপ্তাহিক দামাম পত্রিকার সম্পাদক ও লক্ষ্মীপুর প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি গোলাম রহমান, প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক সাপ্তাহিক এলান পত্রিকার সম্পাদক আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া, সাংবাদিক জাকির হোসেন, সাংবাদিক এম এ মঈদ, সাংবাদিক সাইফুল আলম, সাংবাদিক মনোয়ার রহমান খোকনসহ অনেককে হারিয়েছেন।
তার পেশা জীবনের শেষে এসে সরকারি সুযোগ-সুবিধাও পেয়েছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সমাজসেবা কার্যালয়ের সহযোগিতায় নিজের আর স্ত্রীর বয়স্কভাতা কার্ড করিয়েছেন। দুটি কার্ডের অর্থ ও শতবর্ষী বৃদ্ধ সৈয়দ আহম্মদের ভিক্ষার টাকা দিয়ে কোনোরকম সংসার চলছে। তবে এ চাহিদা তার মিটে না। তাই তিনি ভিক্ষা করেন।
পত্রিকা এজেন্ট মেসার্স রহমানিয়া প্রেসের পরিচালক রাকিব হোসেন জানান, ছোট বেলা থেকে দেখতাম প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে রহমানিয়া প্রেসে চলে আসতেন সৈয়দ চাচা। মাঝে মাঝে সকালবেলা দোকান খুলতে এসে দেখতাম সৈয়দ চাচা বসে আছেন। প্রায় সময়ই তিনি আমাদের আগেই এসে বসে থাকতেন। অনেক সময় রাত পর্যন্তও তিনি পত্রিকা বিক্রি করতেন। পত্রিকার গাড়ি এসে পৌঁছালেই ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। শুরু হয় যেতো তার কাজ। কাজের সময় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হতো না। বর্তমানে ভিক্ষা বৃত্তিতেই সংসার চালাচ্ছেন। বিষয়টা দুঃখজনক।
স্থানীয় দৈনিক মেঘনার পাড় সম্পাদক দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা ও এনটিভির জেলা প্রতিনিধি আবুল কালাম আজাদ জানান, আমরা সংবাদ লিখতাম, সেই সংবাদ পত্রিকা চাপানো হতো। আর চাপানো খবর ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতো শতবর্ষী হকার সৈয়দ আহম্মদ। তার জীবন যুদ্ধ ছিল পত্রিকা নিয়ে। দীর্ঘ বছর পত্রিকা বিক্রি করলেও বর্তমানে সংসারের চাহিদা মিটাতে এখন ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বাম হাতে একটি লাঠি আর কাঁধে ব্যাগ, পরনে পুরোনো বিবর্ণ শার্ট, লুঙ্গি ডান হাতে পত্রিকা নিয়ে ঘুরে ফিরতেন অলিগলি।
লক্ষ্মীপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক নতুন চাঁদের সম্পাদক হোসাইন আহম্মদ হেলাল জানান, বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার পূর্বের লক্ষ্মীপুর থানার সব সময়ের হাজার ঘটনার সাক্ষী ছিলেন খবরের ফেরিওয়ালা সৈয়দ আহম্মদ। পাঠকের কাছে পত্রিকা পৌঁছে দেওয়াই ছিল তার কাজ। কখনো কখনো লক্ষ্মীপুর শহরের পুলের ওপরে বসেও পত্রিকা বিক্রি করতেন তিনি। কিন্তু তার কাঁধে ঝোলানো আছে সে ব্যাগ আর পরনে পুরোনো বিবর্ণ শার্ট, লুঙ্গি ও ডান হাতে লাঠি ও আছে। কিন্তু নেই শুধু পত্রিকা। এখন তার সময় যাচ্ছে কষ্টে। এ সময় সমাজের বিত্তবানদের হকার সৈয়দ আহাম্মদের পাশে দাঁড়ানোর আহবান জানান তিনি।
ডেইলি বাংলাদেশ/এমকে/জেএইচ