রিয়েল এস্টেটের অন্তরালে নাসিমের ভয়ংকর প্রতারণা
প্রকাশিত: ১৪:০০ ২৬ নভেম্বর ২০২০

ইনসেটে নাসিম রিয়েল এস্টেটের মালিক ইমাম হোসেন নাসিম। ছবি: ডেইলি বাংলাদেশ
রাজীব চৌধুরী। পেশায় একজন বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা। স্বল্প উপার্জন করে কষ্টে দিনযাপন করলেও মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজছেন দীর্ঘদিন ধরে। বাসা ভাড়ার বোঝা মাথা থেকে নামাতে পরিবার নিয়ে সুখের নীড় তৈরিতে খুঁজছেন স্বল্প দামের এক টুকরো জমি।
অফিস শেষ করে একদিন ক্লান্ত শরীরে গণপরিবহন করে বাসায় ফিরছিলেন। হঠাৎ রাস্তার পাশে বিশাল এক বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে যায় তার। মোবাইল বের করে সাইনবোর্ডের নাম্বারটা তুলে কল দিলেন। ফোনের ওপাশ থেকে মিস্টি কথায় বিজ্ঞাপনে থাকা দামেই প্লট দেয়ার কথা শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বাসায় গিয়ে পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করেন। পরিবার সম্মতি দেয়ার পর তিনি তার এক আত্মীয় হেলাল উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। জানতে পারলেন, ওই আত্মীয়সহ আরো বেশ কয়েকজন এরই মধ্যে সেখান থেকে প্লট বুকিং দিয়ে রেখেছেন। তিনিও দেরি না করে সেই আত্মীয়কে সঙ্গে নিয়ে পরদিন প্লট বুকিং দিয়ে দিলেন।
ডেইলি বাংলাদেশকে রাজীব চৌধুরী বলেন, হেলাল উদ্দিন চৌধুরী ভাই নিউ মডেল হাই স্কুলের সাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক। ওই স্কুলের শিক্ষকরা ও তাদের আত্মীয়-স্বজন মিলে ১৫০ থেকে ২০০টি প্লট বুকিং দিয়েছে। আমরাও এককালীন ২০ হাজার টাকা করে জমা দেই। তিন কাঠার একটি প্লট দেখিয়ে ৩ লাখ টাকার কিস্তি ধরিয়ে দেয় ওই রিয়েল এস্টেট কোম্পানি। পরে ধীরে ধীরে ২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা পরিশোধ করি।
তিনি বলেন, আমাদের প্লট দেয়ার কথা ছিল আশুলিয়ার তামান্না পার্কের দক্ষিণ পাশে নাসিম রিয়েল এস্টেটের প্রতিষ্ঠান ‘নাসিম সিটি’ নামের একটি হাউজিং প্রকল্পে। জমিতে মাটি কবে ফেলবেন?- এমন প্রশ্নের উত্তর ওই রিয়েল এস্টেট কোম্পানি সব সময় পাশ কাটিয়ে যেতো। ধীরে ধীরে বুঝতে পারি- আমরা ধোঁকাবাজের খপ্পরে পড়েছি। পরে আমরা সবাই মিলে র্যাব-৪ বরাবর অভিযোগ করে সব কাগজপত্র জমা দেই।
নাসিম রিয়েল এস্টেটের প্রতারণায় শিকার আলী আকবর নামের এক মসজিদের ইমাম সাহেবও। প্রতি মাসে মাত্র ২ হাজার ২০০ টাকা করে ১৪ বছর কিস্তি দিলেই তিনি একটি প্লটের মালিক হবেন- এমন স্বপ্নপূরণের সুযোগ পেয়ে নিয়মিত কিস্তির টাকা দিয়েছেন। এরপর র্যাবের অভিযানে নাসিম রিয়েল এস্টেটের মালিক ইমাম হোসেন নাসিম গ্রেফতার হলে জানতে পারেন, তিনি প্রতারিত হয়েছেন।
তিনি বলেন, গতো ১৪ বছরে আমি মোট ৭ লাখ ৪০ হাজার ৬শ’ টাকা দিয়েছি। এমনকি আমার প্লট ২০১৭ সালে বুঝে দেয়ার কথা বলে আরো ৪ লাখ ১২ হাজার ৬শ’ টাকা নিয়েছে। পরে জানতে পারলাম, আমার মতো বহু স্বপ্ন দেখা মানুষ নাসিমের প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
র্যাব-৪ এর আইন কর্মকর্তা আখতারুজ্জামান ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, নাসিমের নামে আমাদের কাছে প্রায় সাড়ে ৩শ’ অভিযোগ আছে। আরো ১শ’র বেশি অভিযোগ আছে থানায়। তার বিরুদ্ধে থানায় এখন পর্যন্ত ২০ থেকে ২৫টি মামলাও হয়েছে। ২০ থেকে ৪০ জন মিলে একেকটি মামলা করেছেন। ৭ জনকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলেও টাকা নিয়েছেন প্রতারক নাসিম।
এ বিষয়ে র্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক বলেন, নাসিমের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আসছে। মানি লন্ডারিংয়ের মামলাও হয়েছে। প্রতারণার অংক ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। দুদকও মামলা করবে। সব মামলা র্যাবের অধীনে তদন্তের জন্য আবেদন করেছি।
তিনি বলেন, মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য আমরা অভিযোগগুলো একত্রিত করে সিআইডিতে পাঠিয়েছি। পাশাপাশি অনুমতি নিয়ে আমরা চেকের কিছু ফটোকপিও পাঠিয়েছি। মানি লন্ডারিং মামলার তদন্তের জন্য সিআইডির বিশেষ ইন্টালিজেন্স শিগগিরই কাজ শুরু করবে।
র্যাবের এই কর্মকর্তা আরো বলেন, নাসিমের বিরুদ্ধে র্যাব-৪ বাদী হয়ে এখন পর্যন্ত ৪টি মামলা করেছে। এর মধ্যে অস্ত্র আইনে দুটি, মাদক আইনে একটি ও জাল টাকা উদ্ধারের ঘটনায় একটি মামলা করেছে। এছাড়া আরো নতুন ৪ থেকে ৫টি মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ৫৫টি মামলায় তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে। কোর্টের মাধ্যমে সিআর মামলাও আছে। আমরাও তার বিষয়ে জানতে চেয়ে রিহ্যাবে চিঠি দিয়েছি।
জানা গেছে, নাসিমের প্রতারণার তালিকায় রয়েছেন- প্রবাসী, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও।
উল্লেখ্য, গত ২ অক্টোবর রাজধানীর রূপনগর এলাকায় একটি গোপন আস্তানা থেকে র্যাবের হাতে গ্রেফতার হন নাসিম রিয়েল এস্টেটের মালিক ইমাম হোসেন নাসিম। তার নামে ৫৫টি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে।
এ সময় নাসিমের আস্তানা থেকে অস্ত্র, মাদকসহ বিভিন্ন জিনিস উদ্ধার করে র্যাব। এর মধ্যে- একটি ৭ পয়েন্ট ৬৫ এম এম বোরের বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন, তিন রাউন্ড গুলি, এক লাখ ৩৫ হাজার টাকার জাল নোট, এক হাজার ৪০০ পিস ইয়াবা, দুই বোতল বিদেশি মদ, চারটি ওয়াকিটকি সেট, ছয়টি পাসপোর্ট, ৩৭টি চেকবই এবং ৩২টি সিমকার্ড রয়েছে।
ঘটনাস্থল থেকে তার স্ত্রী হালিমা আক্তার সালমাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে নাসিমের বিরুদ্ধে র্যাব বাদী হয়ে অস্ত্র আইনে দুটি, মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি ও জাল টাকা উদ্ধারের ঘটনায় একটি মামলা করে।
ডেইলি বাংলাদেশ/এএএম/টিআরএইচ