আর দেখতে পাবেন না সিদ্দিক!
প্রকাশিত: ১২:১১ ২৩ জুলাই ২০১৭
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পাঁচ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করেছিল। আজ সকালে সিদ্দিকের চোখে দেড় ঘন্টা ধরে অস্ত্রোপচার হয়েছে। চিকিৎসা চলছে বিশেষজ্ঞদের মিলিত মতামতের ভিত্তিতেই। এর পরও সিদ্দিকের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার আশা তাঁরা করতে পারছেন না। ‘দৃষ্টিশক্তির সঙ্গে চোখের ভেতরে থাকা কর্নিয়া, জেলসহ নানা বিষয় যুক্ত। আঘাতে সিদ্দিকের ডান চোখ থেকে এই সব কিছুই বের হয়ে এসেছে। আর বাম চোখের ভেতরে সব এলোমেলো হয়ে গেছে।
হাসপাতালের গ্লুকোমা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ইফতেখার মোহাম্মদ মুনির বলছিলেন, আমরা ডান চোখ অপারেশন করেছি। বাম চোখ ওয়াশ করেছি। । তাঁর অধীনেই সিদ্দিকের চিকিৎসা চলছে।
পিতৃহীন সিদ্দিকের এই দুঃসংবাদে তাঁর মা’সহ স্বজনরাও চোখে অন্ধকার দেখছে। ভাইয়ের চোখ ভালো নাও হতে পারে শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন দিনমজুর বড় ভাই নায়েব আলী। ‘কত কষ্ট কইরা আমার ভাইডা পড়ত। কত আশা। কিছুই করতে পারছি না। কিছুই আমরা জানছি না...। ’ বারবার প্রশ্ন তোলেন তিনি, ‘আমার ভাইয়ের কী অপরাধ? তারে ক্যান আন্ধা বানাইয়া দিল...?’ তাঁর সঙ্গে ডুকরে কাঁদছিলেন মা সোলেমা খাতুনসহ পরিবারের অন্যরা। গতকাল শনিবার সহপাঠীসহ অনেকেই সিদ্দিককে দেখতে হাসপাতালে ভিড় করেন।
গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর শাহবাগে সিদ্দিক গুরুতর আহত হন। ওই দিনই রাতে শাহবাগ থানায় পুলিশের দায়েরকৃত মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, মিছিলকারীদের ছোড়া ফুলের টবের আঘাতে তিতুমীর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র সিদ্দিকের দুই চোখ জখম হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা অবশ্য ভিন্ন কথা বলছে। ওই ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজেও দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা সেদিন ব্যানার নিয়ে শাহবাগ থেকে কাঁটাবনমুখী সড়কে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ করছিল। তখন পুলিশ সদস্যরা গিয়ে তাদের ব্যানার কেড়ে নেন। এ সময় পুলিশের অবস্থানস্থল থেকেই কাঁদানে গ্যাসের একটি শেল ছুটে যেতে দেখা যায়। পর মুহূর্তেই দেখা যায় একজন বিক্ষোভকারী (সিদ্দিকুর) মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। তাঁর চোখ ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া তদন্ত করে দোষী শনাক্ত করে শাস্তি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। গতকাল ডিএমপি সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি ঘটনায় এক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তবে তাদের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী। পুলিশ বলছে, তাদের নিজেদের ঢিলাঢিলিতেই ওই শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। শিক্ষার্থীরা দাবি করছে, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে এমনটি ঘটেছে। আমরা সে শিক্ষার্থীর খোঁজখবর রাখছি। ঘটনাটি তদন্ত করা হচ্ছে। দোষী যেই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
অস্ত্রোপচারের পর সিদ্দিককে হাসপাতালের ষষ্ঠ তলার ৬২৮ নম্বর কক্ষে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ইফতেখার মোহাম্মদ মুনির আরো বলেন, ‘যে ধরনের ইনজুরি রয়েছে তাতে সিদ্দিকের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। সম্ভব না বললেই চলে। সে কতটা দেখতে পারবে তা নিয়ে আমরা সন্দিহান। পরবর্তী সময়ে তার আরো একাধিক অপারেশন দরকার হবে। সে এই মুহূর্তে কেবিনে আমাদের ফলোআপে রয়েছে। ’
সিদ্দিকের বন্ধু জাহাঙ্গীর আলম এবং আন্দোলনের সহকর্মী কবি নজরুল কলেজের ছাত্র আসাদুল্লাহ বলেন, দরিদ্র সিদ্দিকুরের চিকিৎসার্থে বন্ধুরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। আসাদুল্লাহ বলেন, ‘গরিব পরিবারের সন্তান সিদ্দিক। আমরা কিছু টাকা তুলছি ওর চিকিৎসার জন্য। জানি না কী হবে। ’
সিদ্দিকের ভাগ্নে রাকিব হাসান জানান, ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার ঢাকেরকান্দা গ্রামে সিদ্দিকের বাড়ি। তাঁর বাবা তহুরউদ্দিন মণ্ডল ১৬-১৭ বছর আগে মারা যান। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সিদ্দিক ছোট। বড় ভাই নায়েব আলী দিনমজুরের কাজ করে সংসারের হাল ধরেন এবং অনেক কষ্ট করে ছোট ভাইকে মাদরাসা থেকে আলেম পাস করান। সিদ্দিক উচ্চশিক্ষার আশায় ঢাকায় এসে তিতুমীর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। থাকেন খিলক্ষেত এলাকার একটি মেসে। টিউশনি করে লেখাপড়া ও মেসের খরচ জোগাড় করতেন সিদ্দিক। এতে ভরসা বাড়ে শ্রমজীবী বড় ভাইয়ের। ছোট ছেলেকে ঘিরে দিনবদলের স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন বৃদ্ধা মাও। বড় ভাইকে সিদ্দিক জানিয়ে দিয়েছিলেন, টিউশনি করে নিজের খরচ নিজেই জোগাড় করতে পারছেন। রাকিব হাসান বলেন, তাঁর মামা বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।
ঘটনার দিন বিকেলেই সিদ্দিককে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে আগারগাঁও জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে চতুর্থ তলার ৪২৫ নম্বর কক্ষে চিকিৎসা চলছিল তাঁর। গত শুক্রবার সেখানকার আবাসিক সার্জন ডা. শ্যামল কুমার সরকার বলেন, ‘সিদ্দিকের দুই চোখ ফেটে গেছে। তাই সে চোখে ভিশন (আলো) পাচ্ছে না। এ ছাড়া তার দুই চোখের পাতা এত বেশি ফুলে আছে যে ভেতরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। অপারেশনের পর বলা যাবে। ’
পরীক্ষার রুটিন ও তারিখ ঘোষণাসহ কয়েকটি দাবিতে বৃহস্পতিবার সকালে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনের রাস্তায় অবস্থান নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়া ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, কবি নজরুল ইসলাম কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও মিরপুর বাঙলা কলেজের বহু শিক্ষার্থী। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুট ওভারব্রিজের পাশের অংশে অবস্থান নেয়। এ সময় তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে।
ডেইলি বাংলাদেশ/আরএডব্লিউ